চিরসবুজ রুদ্রপলাশ যা তার উজ্জ্বল রঙ এবং আকর্ষণীয় গঠন দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নাম রুদ্রপলাশ হলেও এটি আমাদের পরিচিত পলাশ ফুল নয়। শাখান্তে গুচ্ছবদ্ধ ফুলের প্রগাঢ় রক্তিম বর্ণচ্ছটা এবং প্রস্ফুটনের প্রাচুর্য দেখে একে হঠাৎ পলাশের আত্মীয় বলে ভুল করাও অসম্ভব নয়। এই ফুলের কুঁড়িতে পলাশ (Butea monosperma) এর আদল আছে, রংটাও তার মতো এবং স্বভাবে যেন রুদ্র বা উগ্র তাই হয়তো একে রুদ্রপলাশ নামে ডাকা হয় ।
রুদ্রপলাশ ফুল তার উজ্জ্বল রঙ, আকর্ষণীয় গঠন এবং নানা উপকারিতার জন্য পরিচিত। প্রকৃতির মাঝে এই ফুলের উপস্থিতি আমাদের চারপাশকে আরও সুন্দর করে তোলে এবং আমাদের মনকে আনন্দিত করে। আপনি যদি আপনার বাগানে একটি উজ্জ্বল সংযোজন করতে চান, তবে রুদ্রপলাশ হতে পারে একটি চমৎকার পছন্দ।
১৫ থেকে ২০ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন একটি চিরসবুজ গাছ। কোথাও কোথাও এর বেশি উচ্চতার রুদ্রপলাশের দেখা মেলে। বসন্তের শুরুতে উজ্জ্বল সবুজ পাতার রুদ্রপলাশগাছের ডালে ডালে থোকায় থোকায় লাল রঙের ফুল ফোটে। কোথাও কোথাও হলুদ রঙের রুদ্রপলাশেরও দেখা পাওয়া যায়। ফুলের ভেতরের অংশ লালচে সোনালি। পাপড়ির চারপাশে হলুদ রঙের বর্ডার। কলসির মতো ফুলটিতে পানি জমে। এই পানি সুস্বাদু—মিষ্টি। ফুলের বোঁটা বাঘের নখের মতো বাঁকানো এবং গাঢ় সবুজ।
রুদ্রপলাশ ফুলের কুঁড়ি দেখতে আমাদের পলাশ ফুলের কুড়ির মতোই অনেকটা। গাছের ডালের শীর্ষে গোলাকার মঞ্জরিতে ফুল আসে। মঞ্জরির সমস্ত কুঁড়ি একসাথে ফোটে না, ধাপে ধাপে দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে ফুটতে থাকে। উজ্জ্বল লাল রুদ্রপলাশের ভেতরের অংশ লালচে সোনালি আর পাপড়ির কিনারা কোঁকড়ানো এবং চারপাশে হলুদ বর্ডার। ফুল ১০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৫ সেন্টিমিটার চওড়া হয়। রুদ্রপলাশের পাঁপড়ি থাকে ৫ টি। তবে পাঁপড়ি গুলি একসাথে যুক্ত থাকে বলে ফানেলের মত মনে হয়।
ফুল ফোটার পর গাছে ফল আসে। একটি মঞ্জরি থেকে ২ থেকে ৪ টি লম্বা লম্বা ফল ধরে। পরিনত ফল পেঁকে গিয়ে লম্বালম্বি ভাবে ফেটে যায়। ফলের ফাটা অংশ দুটি নৌকার মত দেখতে হয়। প্রতিটি ফলের ভিতরে প্রায় ৫০০ টি স্বচ্ছ ডানা যুক্ত ক্ষুদ্র হৃদয় আকৃতির বীজ থাকে।
রুদ্রপলাশ ফুল সাধারণত গ্রীষ্মকালে ফোটে এবং এর রঙের প্রাবল্য দেখে সহজেই চোখে পড়ে। এটি প্রধানত লাল, কমলা বা আগুনের মতো উজ্জ্বল রঙের হয়ে থাকে। এই ফুলের আরেকটি নাম ‘আগুনি ফুল’ যা তার জ্বলন্ত রঙের জন্যই পরিচিত। গাছের চূড়ায় অগ্নি শিখার মতো মনে হয় বলে একে ফ্লেমিং ট্রি বা ফ্লেম অফ দি ফরেস্ট বলা হয়, যা কৃষঞ্চূড়া বা আরো কিছু গাছের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে।
এর আদিবাস পশ্চিম আফ্রিকা হলেও আমাদের দেশে এর পরিচিতি আছে। দূর থেকে দেখতে থোকা থোকা টিউলিপ সদৃশ বলে এর ইংরাজি নাম আফ্রিকান টিউলিপ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Spathodea campanulata (ইংরেজি: fountain tree, African tulip tree, pichkari or Nandi flame) হচ্ছে বিগ্নোনিয়াসি পরিবারের একটি উদ্ভিদ। অন্যাণ্য স্থানীয় নামের মধ্যে Fountaintree, Rugtoora ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সুদান, জাম্বিয়া ইত্যাদি আফ্রিকান দেশের গাছ হলেও ন্যাচারালাইজড্ বা পরিবেশানুগ হয়েছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপোর, আমেরিকার ফ্লোরিডা, হাওয়াই এবং অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও বেশ কিছু দেশে। হাওয়াই এবং অস্ট্রেলিয়াতে এদের উইড বা স্লিপার উইড (Sleeper Weed) হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ‘স্লিপার উইড’ বলতে বোঝায় সেই সব গাছ যা সুপ্ত অবস্থায় থাকে অনেক বছর তারপর বন্যা ক্ষরা অগ্নিকাণ্ড প্লাবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে অকস্মাৎ আত্মপ্রকাশ করে।
রুদ্রপলাশ গাছ মাঝারি উচ্চতার হয়, সাধারণত ৬-১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এর পাতা ত্রিপক্ষীয়, অর্থাৎ একটি পাতায় তিনটি পাতিকা থাকে। গাছের শাখা-প্রশাখাগুলোতে ফুলের গুচ্ছ থাকে যা দেখতে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।
আফ্রিকান টিউলিপ দীর্ঘাকৃতির বৃক্ষ। কাণ্ড সরল, উন্নত এবং শাখা-প্রশাখা এলোমেলো, বাকল ম্লান-ধূসর, মসৃণ এবং গ্রথন আঁশযুক্ত। যৌগিক পত্র বিরাট ও বিন্যাস বিপ্রতীপ। পাতারা শাখান্তে থাকায় গাছটি ছায়াঘন নয়। বৃক্ষ পত্রমোচী হলেও বছরে কোনো সময়ই সম্পূর্ণ উদোম হয় না। ছিন্ন, বিবর্ণ কিছু পাতা চৈত্র-বৈশাখের প্রচণ্ড রৌদ্র এবং শুষ্কতায়ও শাখায় বিক্ষিপ্ত থাকে। বসন্ত নতুন পাতা আর প্রস্ফুটনের ঋতু। কচি পাতার উজ্জ্বল-সবুজ আর পুষ্পিত মঞ্জরির উচ্ছ্বসিত রক্তিম বর্ণচ্ছটায় সুদর্শন এই পুষ্পতরু সমকালীন সব গাছকে হার মানায়। এ ফুলের গন্ধ উৎকট এবং বাদুড়েরা সম্ভবত এই জন্যই আকৃষ্ট হয়। এরাই পরাগায়নের সহযোগী। বসন্ত ছাড়া বছরের অন্য সময়ে দু-এক স্তবক ফুল ফোটা অসম্ভব কিছু নয়। ফল দেখতে বর্শাফলকের মতো। সাধারণত বর্ষার শেষেই ফল পাকার মৌসুম।
চাষাবাদ ও পরিচর্যা
রুদ্রপলাশ গাছ বীজ এবং কাণ্ডের কাটিং থেকে জন্মানো যায়। এই গাছটি শুকনো এবং উর্বর মাটিতে ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়। যদিও এটি বিশেষ যত্ন ছাড়াই বেড়ে উঠতে পারে, তবে নিয়মিত জলসেচন এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোক পেলে এই গাছটি আরও ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়।
উপকারিতা
রুদ্রপলাশ ফুল শুধু সৌন্দর্যের জন্যই নয়, এর নানা উপকারিতাও রয়েছে। এর ফুল ও পাতা থেকে প্রাকৃতিক রং তৈরি করা হয় যা কাপড় রঙ করার কাজে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, এর ছাল থেকে প্রাপ্ত রজন বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।