অনেকে শরিফা ফল নামে চিনলেও পর্তুগিজ ভাষায় একে আতা বলা হয়। পর্তুগিজরা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগে এ ফলটিকে আমাদের দেশে নিয়ে আসেন। আতা হল অ্যানোনা গণের এক ধরনের যৌগিক ফল। শরিফা (ইংরেজি: Custard Apple বা Sugar Apple) একটি মিষ্টি ও সুগন্ধযুক্ত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল, যা বাংলাদেশে আতা, শরীফা, মেওয়া, মাদার এবং নোনা ফল নামে পরিচিত। এটি Annona squamosa প্রজাতির অন্তর্গত এবং অ্যানোনেসি (Annonaceae) পরিবারের সদস্য।
এ ফলটির গাছের উচ্চতা বেশি (প্রায় ১০ মিটার) এবং ফেব্রুয়ারি/মার্চ মাসে ফল সংগ্রহ করা হয়। এলাকা ভেদে ফল গোলাকার, ডিম্বাকার ও হৃদপিণ্ডাকার হয়। সাধারণত একটি ফলের ওজন ১০০ গ্রাম থেকে ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। খাবারযোগ্য শাঁস বা পাল্পের পরিমাণ ফলের মোট ওজনের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। শাঁসের রঙ সাদা ও ক্রিম ধরনের। শাঁস মিষ্টি ও সুস্বাদু। এতে চিনির মত মিহি দানা থাকে। ফলের টিএসএস ১৮ থেকে ২৪% হয়ে থাকে। ফলের আকার ও প্রকার ভেদে কোষের সংখ্যা ১৯ থেকে ৫৪টি হয়। বীজ কালো, শক্ত এবং প্রায় ৩ থেকে ৪ বছর পর্যন্ত এর অংকুরোদগম ক্ষমতা বজায় থাকে।
শরিফা ফল পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি সুস্বাদু ফল, যা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে। ফলের বাইরের অংশ গোলাকার ও খণ্ডযুক্ত, ভিতরে নরম সাদা বা ক্রিম রঙের শাঁস এবং কালো বীজ থাকে। বীজ বিষাক্ত, তাই শুধু শাঁস খাওয়া হয় ।আতা বা শরিফা ফল চাষ পদ্ধতি বাংলাদেশে জনপ্রিয় না হওয়ার কারেণে সচরাচর শরিফা ফলের চাষাবাদ দেখা যায়না।
পুষ্টিমান: শরিফার শাঁসের প্রতি ১০০ গ্রামের মধ্যে ৭০.৫ থেকে ৭৩.৩ গ্রাম পানি, ১.৬ গ্রাম আমিষ, ২৩.৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৩.১ গ্রাম আঁশ, ১৭ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১.০- ৪.৩১ মিলিগ্রাম লৌহ, ৮৪ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, ৪৭ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ০.৮ মিলিগ্রাম জিংক ও ০.৬৪ মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজ এবং ১০৪ কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। এছাড়াও এতে অল্প পরিমাণে থায়ামিন, রাইবোফ্লাবিন, নায়াসিন, ভিটামিন সি পাওয়া যায়। আয়ুর্বেদ চিকিত্সা শাস্ত্রে ঔষধ হিসেবে এর মূল্য অনেক।
আমাদের দেশে এর ব্যবসায়িক পরিমন্ডল সেভাবে এখোনো গড়ে ওঠেনি। আদি ফল হিসাবে আগে বাড়ির আঙ্গিনায় ও চারপাশে অথবা জঙ্গলে, অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠেছে। স্থানীয় বাজারে বিক্রয় হলেও সেভাবে এই ফলের প্রচার ছিলোনা। বর্তমানে আমাদের দেশে বানি্যজিক ভাবে আতা ফলের চাষাবাদ শুরু হয়েছে, এবং বাজার মূল্য অন্য ফলের তুলনায় অনেক বেশি। যার কারণে দিনদিন এদেশের মানুষ আতাফল বা শরিফা ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছে।
মাটি ও জলবায়ু:
পানি দাঁড়ায় না এমন উঁচু জমিতে, বসতবাড়ির খোলা জায়গায় এবং অল্প ছায়াযুক্ত স্থানেও শরিফা গাছ লাগানো যায়। তবে বেলে দোঁআশ মাটিতে সবচেয়ে ভাল হয়। অম্ল স্বাদযুক্ত পাহাড়ি মাটিতেও এ গাছ ভাল হয়। শরিফা গাছ শুষ্ক ও গরম পরিবেশ পছন্দ করে।
চারা তৈরি:
বীজ থেকে সাধারণত শরিফার চারা তৈরি করা হয়। বীজের গাছও দুই-তিন বছর বয়স থেকে ফল দেয়া শুরু করে। পুষ্ট ও নিরোগ বীজ থেকে চারা উত্পাদন করতে হয়। বীজ থেকে চারা অংকুরিত হতে দুই-তিন মাস সময় লাগে। বীজের আবরণ বেশ শক্ত। তাই পানিতে ভিজিয়ে বপন করলে তাড়াতাড়ি গজায়। বীজতলায় এবং পলিথিনের ব্যাগে চারা উত্পাদন করা যায়। ৪ থেকে ৫ মাস বয়সী সুস্থ চারা বা কলম মূল জমিতে লাগাতে হয়। জুন-জুলাই মাস চারা রোপণের জন্য উত্তম। ইদানিং গ্রাফটিং করেও চারা তৈরি করা হচ্ছে। ৬ থেকে ১২ মাস বয়সী চারার উপর ভিনিয়ার এবং ক্লেফট্ গ্রাফটিং করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে জুন-জুলাই মাস পর্যন্ত গ্রাফটিং করার উপযুক্ত সময়।
রোগ-বালাই:
পোকামাকড়ের আক্রমণ তেমন দেখা না গেলেও মিলিবাগ ফল এর উপর আক্রমণ করে। গাছ ছোট হওয়াতে সহজেই হাত দিয়ে এ পোকা দমন করা যায়। তাছাড়া একধরনের পিঁপড়া (গ্রিন টি পিঁপড়া) বাসা তৈরি করে অসুবিধার সৃষ্টি করে।
ফল সংগ্রহ:
ফুল ফোটার পর থেকে ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে ফল পুষ্ট হয়। পুষ্ট ফল হালকা সবুজ থেকে হলুদাভ সবুজ হয়ে থাকে। পরিপক্ক ফল সংগ্রহ করার ২ থেকে ১ দিনের মধ্যে পাকতে শুরু করে এবং পাকলে তাড়াতাড়ি নরম হয়ে যায়। একটি গাছে প্রায় ১০০টি ফল ধরে।
শরিফা ফলের উপকারিতা
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
উচ্চ ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (যেমন ফ্ল্যাভোনয়েড) থাকায় এটি সংক্রমণ ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ (ক্যান্সার, হৃদরোগ) প্রতিরোধে সাহায্য করে
২. হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা
পটাসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায় ।
৩.হজমশক্তি উন্নত করে
উচ্চ আঁশযুক্ত হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেটের সমস্যা দূর করে ।
৪. দৃষ্টিশক্তি ও হাড়ের স্বাস্থ্য
ভিটামিন এ, রিবোফ্লাভিন ও ক্যালসিয়াম চোখের স্বাস্থ্য ও হাড় মজবুত রাখে ।
৫.ক্তস্বল্পতা দূর করে
আয়রন ও ফোলেট সমৃদ্ধ হওয়ায় হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সাহায্য করে ।
৬.ত্বক ও চুলের যত্ন
ভিটামিন সি কোলাজেন উৎপাদন বাড়ায়, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের বার্ধক্য রোধ করে। চুলের বৃদ্ধিতেও সহায়ক ।
৭. শক্তি বৃদ্ধি ও ওজন নিয়ন্ত্রণ
প্রাকৃতিক শর্করা ও ক্যালোরি দেহে শক্তি জোগায়, আঁশ থাকায় ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
৮. প্রদাহ ও ব্যথা কমাতে
অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আর্থ্রাইটিস বা হাঁপানির লক্ষণ কমায় ।
৯. মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য
ভিটামিন বি৬ সেরোটোনিন ও ডোপামিন উৎপাদনে সাহায্য করে, যা মানসিক চাপ ও হতাশা কমাতে পারে ।
১০. ঔষধি ব্যবহার
গাছের মূলের রস আমাশয় নিরাময়ে, পাতার রস উকুন দমনে ব্যবহৃত হয় ।
সতর্কতা
বীজ বিষাক্ত, খাওয়া যাবে না ।
ডায়াবেটিস রোগীদের পরিমিত খাওয়া উচিত (মিষ্টি স্বাদের জন্য) ।
অত্যধিক সেবনে কোষ্ঠকাঠিন্য বা ঠান্ডা লাগার সমস্যা হতে পারে ।