আনারকলি বা প্যাশন ফল বাংলাদেশে এটি একটি অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। প্যাশন ফল বহুবর্ষজীবী লতা জাতীয় উদ্ভিদ। অনেকের কাছে এটি ট্যাং ফল নামে পরিচিত। এটি Passifloraceae গোত্রের ফল যার ইংরেজি নাম Passion fruit এবং বৈজ্ঞানিক নাম Passiflora edulis।
প্যাশন ফল দুই ধরনের। পার্পল প্যাশন ফল (Passiflora edulis) ও হলুদ প্যাশন ফল (Passiflora edulis var flavicarpa) পার্পল প্যাশন ফল থেকে প্রাকৃতিক মিউটেশনের মাধ্যমে হলুদ প্যাশন ফল উৎপত্তি হয়েছে, যা আকারে ও গুণাগুণে মাতৃ পার্পল প্যাশন ফল থেকে উন্নত।
পাঁচ পাপড়িসমৃদ্ধ প্যাশন ফলের ফুল অত্যন্ত আকর্ষণীয়, মনোমুগ্ধকর, দৃষ্টিনন্দন ও সুগন্ধিযুক্ত। দেখতে অনেকটা ঝুমকোলতার ফুলের মতো। ফুলপ্রেমী একজন মানুষ এ ফুলকে দেখে হাত দিয়ে স্পর্শ না করে বা তার গন্ধ না নিলে যেন তার তৃপ্তিই মেটে না।
প্যাশন ফলের বীজকে আবৃত করে থাকা হলুদ, জিলাটিনাস, সুগন্ধিযুক্ত পাল্পকে পানিতে দ্রবীভূত করে খুবই উপাদেয় শরবত প্রস্তুত করা যায়। এটিকে অন্যান্য জুসের সঙ্গেও মিশ্রিত করে খাওয়া যায়। পাল্পকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে আইসক্রিম, জুস, স্কোয়াশ, জ্যাম ও জেলি তৈরি করা যায়। ফ্রেশ ফল হিসেবেও খাওয়া যায়।
বীজ ও খোসা থেকে পেকটিন ও উচ্চমাত্রায় লিনোলিক অ্যাসিডসমৃদ্ধ তেল আহরণ করা সম্ভব। ফলের আকার দৈর্ঘ্যে ৪ থেকে ৭ সেন্টিমিটার ও প্রস্থে ৪ থেকে ৬ সেন্টিমিটার। পাল্প ও জুসের রং হলুদ এবং টিএসএস ১০-১৪%।
ট্যাং চাষে কোনো সার, সেচ, কীটনাশক এমনকি পরিচর্যারও প্রয়োজন হয় না। শুধু শিম বা লাউ-কুমড়া গাছের মতো মাটিতে চারা লাগানোর পর তা বড় হলে বাঁশের মাচায় অথবা বড় গাছে উঠিয়ে দিলেই হয়।
তিনি বলেন, বাজারে প্রচলিত কেমিক্যালমিশ্রিত শরবতের চেয়ে প্যাশন বা ট্যাং ফল দিয়ে তৈরি শরবত অনেক বেশি সুস্বাদু ও প্রাকৃতিক গুণসম্পন্ন।
বংশবিস্তারঃ
প্যাশন ফলের বংশবিস্তার তিন ভাবে করা যায়ঃ
ক) বীজ দ্বারাঃ ফলের পাল্প থেকে বীজ আলাদা করে পানি দ্বারা ধৌত করে ছায়ায় শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। এ বীজ সরাসরি বীজতলায় অথবা পলিব্যাগে বপন করে চারা তৈরি করা যায়। বীজতলায় ৮-১২ সেমি. দূরে ১-২ সে.মি গভীরে বীজ বপন করে খড় দ্বারা মালচ দিতে হয়। ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে বীজ অংঙ্কুরিত হয়। চারা ২-৪টি পাতা সম্পন্ন হলে বীজ তলা থেকে তা তুলে পলিব্যাগে স্থানান্তর করা যায়। চারার বয়স ৩-৫ মাস হলে চারা ৩০-৪০ সেমি. লম্বা হলে রোপণের উপযু্ক্ত হয়। তবে মনে রাখতে হবে, সংরক্ষিত বীজের সজীবতা থাকে মাত্র ৩-৫ সপ্তাহ।
খ) কাটিং দ্বারাঃ ৩-৪ টি পর্ব বিশিষ্ট শাখা কেটে বংশবিস্তার করা যায়। কাটিং করার সময় শাখার নীচের পর্ব হতে ১-২ সেমি. নীচে তেরেসা করে কাট দিয়ে নীচের পর্বসহ বীজ তলার মাটিতে ৪৫ ডিগ্রী কোন করে উত্তর-দক্ষিণ দিকে মুখ করে মাটিতে রোপণ করতে হবে। কাটিং রোপণের সময় উপরের অংশে ১-২ টি পাতা রেখে বাকি পাতা ফেলে দিতে হবে। ৩৫-৫০ দিন বয়সের মধ্যে কাটিং এর সফলতা লক্ষ্য করা যায়। ৩-৫ মাস বয়সের চারা রোপণের উপযুক্ত হয়। কাটিং করার উপযুক্ত সময় মে-আগষ্ট। কাটিং এর চারায় মাতৃ গুনাগুন বজায় রাখে।
গ) গ্রাফটিং: বর্তমানে প্যাশন ফলে কেফট গ্রাফটিং এর মাধ্যমেও বংশবিস্তার করা যায়। তবে কাটিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার করা সহজ। কাটিং ও গ্রাফটিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার করলে মাতৃ গুনাগুন বজায় থাকে। তবে টিস্যু কালচারের মাধ্যমেও প্যাশন ফলের বংশবিস্তার করা সম্ভব।
চারা রোপণ ও সার ব্যবস্থাপনাঃ
চারা রোপণের জন্য উপযুক্ত সময় হচ্ছে মে-আগষ্ট। ২-৪ মি. x ২.৫-৫.০ মি. দূরত্বে এ ফলের চারা রোপণ করা হয়। রোপণের জন্য ৫০ x ৫০ x ৫০ সেমি. আকারের গর্ত তৈরি করে প্রতি গর্তে ২০-২৫ কেজি পঁচা গোবর, ২০০-৩০০ ইউরিয়া ও টিএসপি এবং ৪০০-৫০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করা হয়। চারা রোপণের পর মাটিতে উপযুক্ত আর্দ্রতা রাখার জন্য সেচ দিতে হবে। তবে ভালো ফলনের জন্য ফুল আসা ও ফলের বিকাশের সময় মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকা দরকার। ফলে খরা মৌসুমেও সেচ প্রদান করা প্রয়োজন। তবে বর্ষাকালে যেন গাছের গোড়ায় পানি জমতে না পারে সেজন্য পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
প্যাশন ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য মাচা তৈরি করা হয়ে থাকে। চারার গোড়ায় খুঁটি পুঁতে গাছ উঠিয়ে দেওয়া হয়। গাছ মাটির উপর উঠলে গাছের অগ্রভাগ কেটে দেওয়া হয় যাতে শাখা বের হয় এবং সমস্ত মাচা ছড়িয়ে পড়ে। মাটি থেকে মাচা পর্যন্ত গাছের কাণ্ডে কোন শাখা বের হলে তা কেটে দেওয়া হয়। বাড়ির আশে পাশে মাচা তৈরি করে বা বড় ফলের গাছে বা সবজির বেড়ায় উঠিয়ে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় সব সময় আগাছা দমন করতে হবে। তবে প্যাশন ফলের বাগানে ইদুরের উপদ্রব বেশি দেখা দিলে তা দমন করতে হবে।
গাছের গোড়া থেকে ১.৫- ২.০ মিটার পর্যস্ত কোন ডালপালা রাখা যায় না। তাই এ সমস্ত ডালা সব সময় কেটে দেওয়া ভালো। যেহেতু নতুন শাখায় বেশি ফুল ও ফল উৎপন্ন হয় তাই প্রতি বছর নিয়মিত কিছু শাখা প্রশাখা কেটে দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে পুরাতন ও মরা ডাল কেটে দিতে হয়। এতে রোগ বালাই কম হবে। শীতকালই ডাল ছাঁটাইকরণের উপযুক্ত সময়।
প্যাশন ফলে বছরে দুইবার ফল পাওয়া যায়। প্রথমবার মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল আসে এবং জুন-আগষ্ট মাসে ফল পাওয়া যায়। দ্বিতীয়বার জুলাই-আগষ্ট মাসে ফুল আসে এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ফল পাওয়া যায়। গাছ লাগানোর ১৪-২০ মাসের মধ্যেই ফল পাওয়া যায়। প্যাশন ফুল পর-পরাগী, ফুল দুপুরে উন্মুক্ত হয় এবং সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের মাছি, মৌমাছি, বোলতা ইত্যাদি দ্বারা পরাগায়ন সম্পন্ন হয়। তবে হাত দিয়ে পরাগায়ন করা যায়। এতে সফলতার হার অনেক বেশি। ফুল থেকে কুঁড়ি হতে ১৭-৪৬ দিন সময় লাগে। ফুল থেকে ফল পরিপক্ক হতে সময় লাগে ৬০-৯০ দিন।
রোগঃ
প্যাশন ফলের গাছ উইডনেস ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়। এ রোগে আক্রান্ত পাতা বিবর্ণ হয়ে যায় ও আকারে ছোট হয়। এছাড়া সেপটোরিয়া স্পট, ব্রাউন স্পট, ফাইটোপথোরা ব্লাইট, অলটারনারিয়া স্পট ও গোড়া পচা রোগ দেখা যায়। ম্যানকোজেব গ্রুপের যেকোন ছত্রাক নাশক দিয়ে এ রোগ দমন করা যায়।
পোকা মাকড়ঃ
কচি ফলে মাছিপোকা ছিদ্র করে ডিম পাড়ে, এতে ফল কুঁচকে যায় এবং ফলের আকার বিকৃত হয়ে অপরিপক্ক অবস্থায় ঝরে পড়ে। এছাড়াও মিলিবাগ ও মাইট দ্বারাও গাছ আক্রান্ত হতে পারে। মার্বেল আকৃতি হলে ম্যালাথিয়ন/ডেসিস/সুমিথিয়ন (২ মিলি/ লিটার পানিতে মিশিয়ে ) ১০-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করে পোকা দমন করা যায়।
ফলনঃ
১৮-২০ মাস বয়সের একটি গাছে ১০০-২০০ টি ফল পাওয়া যায় অর্থাৎ গাছ প্রতি ৫-১০ কেজি।