নাশপাতি একটি বিদেশি ফল। এই ফলটা দেখতে অনেকটা পেয়ারার মতো। খেতে পেয়ারা থেকে অনেক বেশি সুস্বাদু। তাই আপনার ছাদবাগানে অথবা বাড়ির পাশে একটি নাশপাতি চারা রোপন করলে আশাকরি আপনার বাসার ফলের চাহিদা পূরণ হবে। এটি একটি বিদেশী ফল হলেও আমাদের দেশে কম বেশি সকলেই ফলটির সাথে পরিচিত।
নাশপাতি ইংরেজি: Pear রোজাসিয়ে পরিবারের Pyrus paɪrəs, গণভূক্ত উদ্ভিদ ও তার ফলবিশেষ। ঠাণ্ডা অবস্থায় পাকা নাশপাতিতে চমৎকার সুগন্ধ রয়েছে। ফলের ৮৩ শতাংশই পানিতে পরিপূর্ণ। আবরণ অংশটি সবুজ অথবা লালচে প্রকৃতির হয়ে থাকে। ফলের কেন্দ্রস্থলটি বেশ নরম। সারা পৃথিবীতে নাশপাতির অনেক প্রজাতি রয়েছে। এগুলো হলো এশিয়ান নাশপাতি, জাপানিজ নাশপাতি, চীনা নাশপাতি, কোরিয়ান নাশপাতি, তাইওয়ানের নাশপাতি, আপেল নাশপাতি, প্যাপেল নাশপাতি এবং বালি নাশপাতি।
জ্যাম, জেলি অথবা রসালো অবস্থায় বাজারজাতকরণ করা হয়ে থাকে। শক্ত ভূমিতে নাশপাতি গাছ ভাল জন্মে। ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশ থেকে গাছটির উৎপত্তি ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়। নাশপাতি মূলত শীতপ্রধান অঞ্চলের ফল। তবে এগুলোর মধ্যে এশিয়ান নাশপাতি অপেক্ষাকৃত উচ্চতাপমাত্রায় জন্মাতে ও ফলন দিতে পারে।
আমদানিকৃত নাশপাতিগুলো কখনও স্বাদে মিষ্টি, কখনও স্বাদে কিছুটা পানসে প্রকৃতির হয়ে থাকে। তারপরও প্রতি বছর বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে এই ফলটি আমদানি করতে হয়। নাশপাতি একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল। এ ফলে শর্করা, ক্যালরি, চিনি, বিভিন্ন ডায়েটারি ফাইবার, চর্বি, প্রোটিন, বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় ভিটামিনস এবং খনিজ বিদ্যমান।
গাছ ১২ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। শীতে পাতা ঝরে। গ্রীষ্মে একসঙ্গে ফুল ও পাতা আসে। ফুলের রং সাদা, ডালের যেকোনো প্রান্তে গুচ্ছবদ্ধভাবে ফোটে। ফুলের অবারিত প্রস্ফুটন-প্রাচুর্য দারুণ উপাভোগ্য। ফল দেখতে অনেকটা পেয়ারার আকৃতির।
ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকলেও আমাদের দেশে সহজলভ্য জাতটি বরাবরই খয়েরি রঙের। জংলি নাশপাতিগাছের চারা তৈরি করে তাতে ভালো জাতের নাশপাতির চোখ কলম করে চারা তৈরি করা যায়। এতে ফলন ভালো হয়। তবে সঠিক সময়ের আগে ফল তুললে টক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে ফল পাড়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এশিয়ায় নাশপাতির প্রায় ২০ রকম আবাদি জাত বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধান উৎপাদক দেশ চীন ও জাপান।
নাশপাতি একটি সম্ভাবনাময় বিদেশি ফল। তবে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে অতি সীমিত আকারে নাশপাতির চাষ শুরু হয়েছে।
আমাদের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে নাশপাতি ভাল জন্মে। এখানে যেটা জন্মে সেটা কিছুটা লম্বাটে, ধূসর থেকে বাদামি ও কালচে বর্ণের। পাকলে হালকা কপি বর্ণের হয়। সিলেট এলাকায় যে জাতটির চাষ হয় তা অনেকটা বুনো ধরনের।
মাটি ও আবহাওয়া:
নাশপাতি শীতপ্রধান অঞ্চলের ফল হলেও নতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় এর সফল উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় আবহাওয়া নাশপাতি চাষের অনুকূলে। সুনিষ্কাশিত, উর্বর দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে নাশপাতি চাষ করা যায়।
বংশ বিস্তার:
সাধারণত কুড়ি সংযোজনের মাধ্যমে নাশপাতির বংশ বিস্তার করা যায়। তবে গুটি বিস্তার পদ্ধতিতে ও চাষাবাদ করা যায়। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে কলম বাঁধা হয়। কলম তৈরির জন্য লেবু লিচু ইত্যাদির মত উপাদান ব্যবহার করা যায়। জুলাই-আগষ্টে কলম কাটার উপযোগী সময়।
চারা রোপণ ও সার প্রয়োগ:
সাধারণত বর্ষাকালে চারা কলম রোপণ করা হয়। মধ্য জুন থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যনত্দ চারা রোপণ করা যায়। রোপণ দূরত্ব হবে ৪ থেকে ৬ মিটার। বসতবাড়ির আশপাশের ঢালু জমিতেও চারা রোপণ করা যায়। পাহাড়ের ঢালে নির্দিষ্ট দূরত্বে নাশপাতির চাষ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। ৬০ সেন্টিমিটার থেকে ১ মিটার গভীর ও চওড়া গর্তের মাটির সঙ্গে পচা গোবর ১৫ থেকে ২০ কেজি, খৈল ১ কেজি, টিএসপি ৫০০ গ্রাম এবং এমপি ২৫০ গ্রাম। সার ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে উপাদানগুলো পচাতে হবে। নাশপাতি গাছে নাইট্রোজেন সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তাই গাছ লাগানোর ৩০ থেকে ৪০ দিন পর গাছ প্রতি ১০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। ১ থেকে ৫ বছর বয়সী গাছে ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। বয়স্ক ও ফলনত্দ গাছে বর্ষা মৌসুমের আগে এবং পরে মধ্য জ্যৈষ্ঠ এবং আশ্বিনের শেষে পচা গোবর ৩০ কেজি, খৈল ২ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, এবং টিএসপি ৪০০ গ্রাম দিতে হবে। গাছের গোড়া থেকে অনত্দত ১ মিটার দূরত্বে বৃত্তাকারে ২৫ সেন্টিমিটার গভীর ও চওড়া নালা করে উত্তোলিত মাটির সঙ্গে যাবতীয় সার ভালভাবে মিশিয়ে নালা ভরাট করে দিতে হবে।
রোগ ও পোকামাকড়:
নাশপাতির বিভিন্ন রোগের মধ্যে কাণ্ডের কালো ফাঙ্গাস রোগই প্রধান। যে কোন বয়সের ডালে এ রোগ হতে পারে। প্রতিকারের জন্য, আক্রানত্দ শাখা ছেটে দিতে হবে এবং ক্ষতস্থানে বোর্দোপেষ্ট লাগাতে হবে। এছাড়া পুরানো কাণ্ডে কালো ব্যান্ড হয়, যা পার্বত্য এলাকার নাশপাতির একটি প্রধান রোগ। নাশপাতিতে কাণ্ডছিদ্রকারী পোকা ও উঁই পোকার আক্রমণ বেশি। কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকাগুলোর শুটকীট কাণ্ড ছিদ্র করে। ফলে আক্রানত্দ ডাল শুকিয়ে মরে যায়।
ফল সংগ্রহ ও ফলন: কলমের গাছে রোপণের ২ থেকে ৩ বছর পর থেকেই ফল দেয়া শুরু করে। মার্চ-এপ্রিলে ফুল আসে এবং জুলাই আগষ্ট মাসে ফল পরিপক্ক হয়। ফল ধারণ গাছের বয়স ও বাড়নত্দের ওপর নির্ভর করে। বয়স্ক গাছে বার্ষিক গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টির মত ফল ধরে।