কৎবেল বা কদবেল আমাদের দেশে একটি পরিচিত ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সুস্বাদু মৌসুমী ফল। এর খোলস শক্ত ও বেলের মত খসখসে। টক স্বাদযুক্ত কদবেল সকল বয়সের লোকের নিকট প্রিয়। কদবেলের খাদ্য উপাদানের পুষ্টি গুণ মানব শরীরের জন্য খুবই উপকারী । সুস্থ সবল দেহ গঠনে এবং দেহের রোগ প্রতিরোধে বলিষ্ঠ ভুমিকা পালন করে কদবেল। প্রায় বেশিরভাগ খাদ্য উপাদানে ভরপুর কদবেল। পাকা কদবেল আমিষ, শর্করা, চর্বি, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি ও সি প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়।
গাছ ২০-৫০ ফুট উঁচু হয়। কাঠ শক্ত ও পর্ণমোচী বা পাতা ঝরা বৃক্ষ। পাতা কামিনী ফুলের পাতার মত। পত্রদণ্ডের দুইদিকে ৫-৭টি পাতা থাকে। ২-৫ ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট টেনিস বলের আকারের কৎবেল টক স্বাদের । গাছে ছোট কাঁটা থাকে। প্রতিটি পাতা ২৫ থেকে ৩৫ মিলিমিটার লম্বা এবং ১০ থেকে ২০ মিলিমিটার চওড়া হয়। পাতা পিষলে লেবুর মতো গন্ধ পাওয়া যায়। গাছে সাদা ফুল ফোটে এবং প্রতিটি ফুলে পাঁচটি পাপড়ি থাকে। কদবেল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Limonia acidissima। এটি রুটেসি গোত্রের উদ্ভিদ। এদের আদি নিবাস ভারত (আন্দামান দ্বীপপুঞ্জসহ), বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। ইংরেজিতে কদবেলকে Elephant Apple বা Monkey fruit নামে ডাকা হয়।
দুই থেকে পাঁচ ইঞ্চি ব্যাসবিশিষ্ট টেনিস বলের আকারের কদবেল টক স্বাদের ফল। কদবেল ফলের বাইরের রং সবুজাভ বাদামি রঙের হয়। পাকা ফলের শক্ত খোসার রং কালচে হয়। ভেতরে থাকে নরম সাদা শাঁসের একটি পাতলা আবরণ ও অম্লমধুর স্বাদের সুগন্ধযুক্ত কালচে বাদামি ঘন শাঁস ও প্রচুর ক্ষুদ্রাকার বীজ।
প্রায় সব ধরনের মাটিতেই কদবেল চাষ হয়। গরম ও শুষ্ক আবহাওয়া এ ফল চাষের পক্ষে উপযুক্ত। বেশি বৃষ্টিপাত ও ঠাণ্ডা জলহাওয়া এদের অপছন্দ। এই ফলের স্বাদ টক ও হালকা মিষ্টি। মুখের স্বাদ বাড়াতে এর তুলনা নেই। আচার, চাটনি কিংবা মাখিয়ে কদবেল খাওয়া যায়। এই ফল কেবল মুখের রুচিই বৃদ্ধি করে না, পেটের নানা সমস্যা দূর করতেও কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
কদবেলের পুষ্টিগুণ
কদবেলের আছে নানা পুষ্টিগুণ। এতে খাদ্যশক্তি রয়েছে কাঁঠাল ও পেয়ারার প্রায় সমান। আমিষের পরিমাণ রয়েছে আমের চেয়ে সাড়ে ৩ গুণ, কাঁঠালের দ্বিগুণ, লিচুর চেয়ে ৩ গুণ, আমলকী ও আনারসের চেয়ে ৪ গুণ বেশি এবং পেঁপের চেয়ে দ্বিগুণের একটু কম।
প্রতি ১০০ গ্রাম কদবেলের পুষ্টিমান পানীয় অংশ ৮৫.৬ গ্রাম, খনিজপদার্থ ২.২ গ্রাম, খাদ্যশক্তি ৪৯ কিলোক্যালোরি, আমিষ ৩.৫ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, শর্করা ৮.৬ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৫.৯ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৬ মিলি গ্রাম, ভিটামিন-বি ০.৮০ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিন-সি ১৩ মিলিগ্রাম এবং প্রতি ১০০ গ্রামের শক্তি উত্পাদন ক্ষমতা ৪৯ কিলো কেলোরি/ জৌলস।
কদবেলের উপকারীতা ও ভেষজগুণ
এই ফল দীর্ঘস্থায়ী কাশি, সর্দি, হাঁপানি, ও যক্ষ্মা রোগ নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকরী আয়ূর্বেদী ঔষুধ।
পেট রোগ নিরাময় : কদবেলে ট্যানিন (tannin) রয়েছে। ট্যানিন দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া ও পেট ব্যথা ভালো করে। কদবেল গাছের বাকল মধু সঙ্গে মিশ্রিত করে খেলে পেটের রোগ আমাশা ভাল করে। কাঁচা কদবেল ছোট এলাচ, মধু দিয়ে মাখিয়ে খেলে বদহজম দূর হয়। এই ফলের নির্যাস কলেরা এবং piles জন্য প্রতিষেধক ওষুধ হিসাবে কাজ করে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধক: কদবেলের নির্যাস ব্যাপকভাবে ডায়াবেটিস চিকিত্সার জন্য আয়ূর্বেদী ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
কদবেল শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: কদবেল শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্নায়ুর শক্তি যোগায়। ত্বকের জ্বালা পোড়া কমাতে কদবেলের ক্বাথ মলম হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
কিডনি সুরক্ষা: কদবেল উদ্দীপক ও মূত্রবর্ধক কাজে বিশেষ উপাদেয়। এ ফল নিয়মিত খেলে কিডনি সুরক্ষা রাখে। প্রাচীন ভারতীয় চিকিত্সা বিজ্ঞানীরা কিডনি সমস্যা দূর করার জন্য সেরা প্রাকৃতিক ঔষধ হিসাবে এটি ব্যবহার করতেন। এ ফল যকৃত্ ও হূিপণ্ডের জন্যও বিশেষ উপকারী ।
দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি: কদবেল উদ্ভিদে বিদ্যমান পিঙ্গল পদার্থ রয়েছে, যা চোখের নানাবিধ সমস্যার পথ্য হিসেবে কাজ করে। এটি চোখের দৃষ্টি শক্তিও বৃদ্ধি করে। চোখের ছত্রাক জনিত রোগে কদবেল পাতা একটি কাপড়ে পুটলি করে হালকা গরম অবস্থায় সেক নিলে চোখে লাল ভাব নিরাময় হয়।
পেপটিক আলসার নিরাময়ে: কদবেল পাতার ক্বাথ পানীর সঙ্গে নিয়মিত পান করলে পেপটিক আলসারের রাতারাতি ভালো হয় এবং আলসারের খত সারাতে তাজা কদবেল বেশ কার্যকরী
রূপচর্চায় সহায়ক : ব্রুণ ও মেছতায় কাঁচা কদবেলের রস মুখে মাখলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
শ্বাসযন্ত্রের রোগ নিরাময়: কদবেল পাতার নির্জাস শ্বাসযন্ত্রের চিকিত্সায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। দুধ এবং চিনি দিয়ে কদবেলের পাতা মিশিয়ে স্নেহপূর্ণ খাদ্য তৈরি হয়, এই রস শিশুদের পেটের ব্যথার চিকিত্সায় চমত্কার কাজ করে। কদবেল যকৃত্ ও হূিপণ্ডের জন্যও বিশেষ উপকারী ।
কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় : কদবেলের ফুল শুকিয়ে পাউডার করে সারা বছর সংরক্ষণ করে রাখা যায়। ফল দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠবদ্ধতা, দীর্ঘস্থায়ী আমাশা দূর করে।
রক্ত স্বল্পতা রোধ :এই ফল রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। এবং বুক ধড়ফড় এবং রক্তের নিম্নচাপ রোধেও সহায়ক। চিনি বা মিছরির সঙ্গে কদবেল পাউডার মিশিয়ে খেলে সঙ্গে শরীরের শক্তি বৃদ্ধি হয় এবং রক্তাল্পতাও দূর হয়।